Rose Good Luckভালবাসার সাতকাহন (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-১০) Rose Good Luck

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২২ অক্টোবর, ২০১৪, ০১:৩৫:২৫ দুপুর



Good Luckশমশেরনগর আবাসিক এলাকার বাসাটিতে নিরুপদ্রবে দিন কেটে যাচ্ছে রায়হানের।

অফুরন্ত অবসর!

বড্ড একঘেয়ে।

তারপরও কিছু কাজ তো থেকেই যায়। মিতুকে স্কুলে দিয়ে আসে রুমা। তবে স্কুল থেকে নিয়ে আসার কাজটি রায়হান করে।

ওদের পাশেই একটি দুই রুমের টিনশেড ইউনিট আগে থেকেই অর্ধসমাপ্ত ছিল। সেটাকে কমপ্লিট করা হল। সেখানে এক ভাড়াটে উঠেছে। লোকটি বয়স্ক। আদম ব্যাপারি। বিদেশে লোক পাঠানোর দালালি করে। তার এক ছেলে এবং এক মেয়ে। ওনার স্ত্রী খুব মিশুক স্বভাবের। কেমন মা মা ভাব জাগে ওনাকে দেখলেই। রুমার সাথে তার অনেক ভাব হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।

এলাকার অনেকের সাথেই মোটামুটি পরিচয় হয়েছে রায়হানের। মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে রায়হান। এর ফলে অন্যান্য মুসল্লিদের সাথে ধীরে ধীরে আলাপ পরিচয় হতে থাকে। দু'একজন করে ওদের বাসায় আসে যায়। ফলে এলাকার বেশ কয়েকটি পরিবারের সাথে রায়হানদের সখ্যতা গড়ে উঠলো।

মিতুকে ধর্মীয় শিক্ষা দানের জন্য এলাকার ইমাম সাহেব বাসায় আসেন। সপ্তাহের এই ক'টি দিন ওনার সাথে একান্তে কিছু আলাপ করা যায়। রায়হানের খুব ভালো লাগে এই মানূষটিকে। ইমাম সাহেব একজন মুক্ত মনের ইসলামী আদর্শের সজ্জন মানুষ। রায়হান ওনার সঙ্গ পেলে খুব রিল্যাক্স বোধ করে।

তবে আলাপচারিতার একটা পর্যায়ে এসে সবাই রায়হানের বেকার জীবন নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তখন খুব খারাপ লাগে ওর। মনের ভিতরে গুমরে চলা কষ্টকর অনুভূতিতে নীল হতে হতে রায়হান নীরব থেকে একটু হাসে। তবে এভাবে মুখের হাসিটিকে ঝুলিয়ে রেখে হৃদয়ের অনুভূতি চেহারায় আসতে না দেয়াটা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বেশীরভাগ মানুষই এটা পারে না। কিন্তু রায়হান তো আর বেশীর ভাগ মানুষের ভিতরে পড়ে না।

ভোর হলে সবাই যখন ওর বাসার সামনে দিয়ে যার যার কাজে বেরিয়ে পড়ে, সে তখন নিজেদের জানালা দিয়ে কর্মজীবি মানুষদের চলে যাবার এই স্রোতটাকে দেখে। আবার এরা সন্ধ্যায় যখন ফিরে আসে, সেই সময়টাতে মাগরিবের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে ফিরবার সময় এদেরকে পাশ কাটিয়ে বাসায় ফিরে।

ক্লান্ত মানুষগুলোর ভিতরে এক ধরণের তৃপ্তির ভাব থাকে। রায়হান সেটা লক্ষ্য করে।

বাউন্ডারি ওয়াল ঘেষে দু'টি দোকানও বানানো হয়েছে। এর ভিতরে একটা মুদি দোকান। অন্যটি চায়ের। দু'টো থেকেই ভাড়া আসে। সেই টাকার সাথে আদম ব্যাপারির ইউনিটটির বাসা ভাড়ার টাকা মিলিয়ে যা হাতে আসে, আপাতত এই-ই রায়হান-রুমার আয়ের পথ। মুদি দোকান থেকে মাসকাবারি চুক্তিতে বাকিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তেল ও অন্যান্য জিনিস নেয়। একটা 'খাতা খোলা' হয়েছে রায়হানের নামে।

রুমার মামা ওদের জন্য আপাতত এই ব্যবস্থাই করেছেন।

রায়হান ভিতরের খালি যায়গাটুকু অযত্নে ফেলে না রেখে কিছু একটা করতে চেয়েছিল। অনেক চিন্তাভাবনা করে। শেষে পেঁপে গাছ লাগায়। কাশিমপুরের বি.এ.ডি.সি থেকে হাইব্রীড জাতের পেঁপে চারা নিয়ে আসে। এর সাথে কিছু দেশী জাতের চারাও নেয়। নির্দিষ্ট দূরত্বে গাছগুলো লাগানো হয়। এই আবাসিকের একেবারে শেষ প্রান্তে স্থানীয় মানুষদের কিছু যায়গা রয়েছে। সেখানে তাঁরা লম্বা টিনের ঘর করে ভাড়া দিয়েছে। ক্যাম্পাসে যে সকল রিক্সাওয়ালারা রিক্সা চালায় তারা তাদের পরিবার নিয়ে এখানেই থাকে। এদের বউ এবং বড় মেয়েরা এই আবাসিকের বাসায় বুয়ার কাজ করে। অনেকে ক্যাম্পাসের টিচারদের বাসায় ও করে। এই মানুষগুলোর অধিকাংশের বাড়ি-ই ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকায়। এদের একজনকে দিয়ে সেখান থেকে উন্নত জাতের ডাটার বীজ আনিয়ে নিয়েছে। এই জাতের ডাটাগুলো এক মানুষ সমান উঁচু হয়। তবে ভিতরে খুবই নরম এবং শাষ থাকে না। খেতে খুবই তৃপ্তিদায়ক।

কামলা দিয়ে বেড বেড করে সে এই ডাটার আবাদ করিয়েছে। কিছু অংশে লাল শাক লাগিয়েছে। এখন শীতকাল। বাঁশ দিয়ে দুটো মাচা বানিয়েছে। একটাতে লাউ এবং অন্যটিতে সীমের ঝাঁকা বানিয়ে নিয়েছে। বাকী যায়গাতে পুঁই শাকের গোড়ার অংশ নির্দিষ্ট দূরত্বে রোপন করায়। ঐ গোড়াগুলো থেকে তাজা পুঁই লতা বের হয়েছে।

সকাল এবং বিকেল বেলা মটর ছেড়ে পাইপ লাগিয়ে ক্ষেতে পানি দেয়ার কাজটি খুব আনন্দের সাথে করে রায়হান। অদূরে বেঞ্চে বসে রুমা এবং মিতু রায়হানের কাজ দেখে। ওরা খুশী হয়। ওর পাপা কত্তো কাজ করে- এই ভাবনাটা মিতুকে আনন্দ দেয়। রুমাও এই ভেবে খুশী হয়- মানুষটা কিছু একটা নিয়ে তো আছে।

মিতু কখনো কখনো ওর পাপার হাত থেকে পানির পাইপ নিয়ে ক্ষেতে পানি দিতে চায়। রায়হান পাইটি ওর হাতে ধরিয়ে দিলে সে অনভ্যস্ত হাতে পানি দিতে গিয়ে নিজে ভিজে... রায়হানকেও ভিজায়। দুষ্টুমি করে রায়হান তখন পাইপটি রুমার দিকেও তাক করে। কপট রাগে সিক্ত রুমা চোখ পাকায়। ওদের তিনজনের এই মৃদু খুনসুটিতে বাউন্ডারি ওয়াল ঘেরা এই টিনশেড সেমি পাকা 'বাগান বাড়িতে' (রায়হান এই নামটি দিয়েছে) সুখ নামের অদৃশ্য জিনিসটি কিছু সময়ের জন্য হাজিরা দিয়ে যায়।

মিতুর জন্য একটা দোলনা বানিয়ে দিয়েছে রায়হান। এর পাশেই বাঁশের মাচা দিয়ে তিনটি বেঞ্চ। দু'পাশে দুটি আর মাঝে একটি। অবিকল ডাইনিং রুমের টি-টেবিলকে ঘিরে সোফা সেটের মত। সেখানে বসে ওরা দুজন বিকেলে চা খায়। পাশে মিতু দোলনায় দোল খেতে থাকে। সামনের ক্ষেতে এক মানুষ সমান লাল রঙের ডাটা জ্যামিতিক আকৃতিতে অবস্থান নিয়ে সগর্বে চেয়ে থাকে... রক্তলাল লাল শাকের বর্গাকৃতি বেড... পুঁই শাকের সবুজ লতানো সজীবতায় বাতাসে দোলানো কচি আগ্রভাগের ডানে বামে ঈষৎ দোল খাওয়া... সীমের ঝাঁকায় পিংক ও লালের কম্বাইন্ড ফুলের সমাহার... সেগুলোতে বর্ণীল প্রজাপতিদের মৌ-বিহার... লাউয়ের মাচায় সারি সারি কচি লাউয়ের মাটি ছুঁই ছুঁই অবস্থান- এসবই রায়হান এবং রুমার দৃষ্টিতে মনোহর লাগে!

নিজেদেরকে অনেক সুখী মনে হয় তখন!

পনের শতাংশ যায়গাকে গিরে থাকা সুউচ্চ বাউন্ডারি ওয়ালের দিকে তাকিয়ে রায়হানের নিজেকে 'রাজা' মনে হয়। পাশে 'রানী' এবং 'রাজকন্যা'! কিন্তু এই অনুভূতি বেশীক্ষণ থাকেনা। সে যে অন্যের যায়গার একজন পাহারাদার মাত্র- এটা মনে আসাতেই সকল ভালোলাগারা দৌড়ে পালায়।

রুমা রায়হানের ভাবান্তর লক্ষ্য করে। জিজ্ঞেস করে,

: কি হয়েছে?

ম্লান হেসে রায়হান উত্তর দেয়,

: কিছু না।

নিজের অনুভূতি এবং দীর্ঘশ্বাসকে গোপন করতে রুমার পাশ থেকে উঠে যায়। ক্রমশঃ গতিশূণ্য হয়ে আসা দোলনাতে বসা মিতুকে দোল দিতে থাকে। দোলনার গতি যত বাড়তে থাকে, মিতুও ততো আনন্দ পায়... হাসে... রায়হানের মনের কষ্টগুলোও পাল্লা দিয়ে বেড়ে যেতে থাকে। ভাবনার জগতে প্রবেশ করে রায়হান ভাবে, রুমার কাছ থেকে এরকম কত কিছুই তো সে এতোদিন গোপন করেছে। আজও না হয় করল।

চিন্তিত রুমা রায়হান ও মিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর মনে এই ভাবনাটা দোলা দিয়ে যায় যে, রায়হান কি এই জীবনে সুখী? চকিতে এটাও মনে হয় তার, সে ও কি রায়হানকে নিয়ে এখনকার এই পরিবেশে সুখী? খুশী?

বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় রুমা। ওর মনে শুধু একটি ভাবনাই আসে- যার যার অবস্থানে থেকেই সীমিত সামর্থ্যের ভিতরেই সুখকে খুঁজে নিতে হয়। সুখ নিজে এসে ধরা দিবে, এটা ভাবাও বোকামি।

রায়হানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় রুমা।

দুজনে মিলে দোলনাকে পিছু টেনে সামনের দিকে ছেড়ে দেয়।

ক্রমাগত দিতেই থাকে।

নিজে স্থির থেকে অন্যের ভিতরে গতি সঞ্চার করাতেই তো সবার আনন্দ! এই এখন যেমন তাঁরা সবাই পাচ্ছে। থেমে থেকে একটু একটু করে সামনে আগানো... একটু পিছনে আসা... আবার সামনে এগিয়ে যাওয়া...

এই তো জীবন!

হ্যা, রুমা এই জীবনে সুখী!!

এই ভাবনাটা রুমার মনে আসতেই সে পাশে থাকা রায়হানকে হাত দিয়ে স্পর্শ করে ভালোবাসা এবং সুখকে উপলব্ধি করতে চায়।

ওদিকে রায়হান ভাবে, কবে যে এমন এমটা শান্তির নীড় ওদের হবে! তিনজনের এই ছোট্ট পরিবারের মাথা গোঁজার একান্ত নিজেদের যায়গা!

আদৌ হবে কি?

কিন্তু ভাবনা চিন্তার এই সময়ে রায়হান আরো দুটি প্রিয় মুখের কথা বেমালুম ভুলে যায়। যারা ওর জন্য তাদের হৃদয়ে সাগরসম ভালোবাসা বয়ে বেড়াচ্ছেন... অনেক দূরের নিভৃত এক মফস্বলে ওর জন্য অপেক্ষা করছেন। যখন বিদ্যুৎ চমকের মত এটা ওর মনে উদয় হয়, তখনই নিজেকে বড্ড স্বার্থপর মনে হয়।

আসলেই কি সে স্বার্থপর নয়?

আজ এই অবস্থার জন্য তো সে দায়ী। বাবা মা আর ছোট ভাই শাহেদকে নিয়ে কত সুন্দর সুখী পরিবারটি ছিল তাদের। সেটা একমাত্র ওর ভুলের কারণেই আজ এই বিচ্ছিন্ন পরিবারে পরিণত হয়েছে।

ভুল, জেদ এবং কিছুটা স্বার্থপরতা... নিজে অনেক বড় হবার উচ্চাশা।

এতটা বড় হতে চেয়েছিল যে নিজের বাবা-মা'কে সেকেন্ডারী ভেবে বিস্মৃত হয়েছিল। তাই আজ সবার চেয়ে নিচে রয়ে গেছে সে।

রুমার দিকে তাকায়। কিছুটা দায় কি রুমারও ছিল না? সেও কি এই দায় এড়াতে পারে? তবে এটাও ভাবে, নিজের দোষ মানুষ যখন অন্যের উপরে চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত করতে চায়- তখন বুঝতে হবে সেই মানুষটি আর স্বাভাবিক মানুষের ভিতরে নাই।

হ্যা, আজ সে একজন অস্বাভাবিক মানুষ।

পৌষের এক বিষন্ন বেলা শেষের মুহুর্তে একজন অস্বাভাবিক মানুষ তার কাছের মানুষদের অতি নিকটে থেকেও ভাবনার গভীরে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়... ক্লান্তিকর গ্লানিতে নিমজ্জিত হতে থাকে... অনেক দূরে সরে এসে চিন্তার মহাসমুদ্রে ওলট পালট হতে থাকে।

অথচ কাছের মানুষেরা এর কিছুই টের পায় না! Rose Good Luck

(ক্রমশঃ)

বিষয়: সাহিত্য

১০২৪ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

277039
২২ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ০২:০১
কাহাফ লিখেছেন :
আমার 'মা' অসুস্হ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি,
সবার কাছে মায়ের সুস্হ্যতার জন্যে দোয়া চাচ্ছি, পরাক্রমশালী আল্লাহ যেন'মা'কে তাড়াতাড়ি পুর্ণ ভালো করে দেন।

(মামুন ভাই,আপনার লেখা প্রায় সবাই পড়ে তো,তাই ১ম মন্তব্যে লিখলাম।)
২২ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৪:৩২
221095
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ কাহাফ ভাই।
আপনার মায়ের জন্য আমরা একটু আগে আসরের নামাজ পড়ে দোয়া করেছি। ইনশা আল্লাহ প্রতি ওয়াক্তে ফরজ নামাজের পরে ওনার সুস্থতার জন্য দোয়া করব।
অন্যান্য সকল ব্লগার ভাইদেরকে কাহাফ ভাইয়ের আম্মার দ্রুত আরোগ্যের জন্য দোয়ার দরখাস্ত করছি।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck
২৩ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৩:৪৩
221183
কাহাফ লিখেছেন :
আমিন ইয়া রাব্বাল আলামিন।
277223
২৩ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৩:৫৭
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ কাহাফ ভাই।
আপনার মায়ের জন্য আমরা একটু আগে আসরের নামাজ পড়ে দোয়া করেছি। ইনশা আল্লাহ প্রতি ওয়াক্তে ফরজ নামাজের পরে ওনার সুস্থতার জন্য দোয়া করব।
অন্যান্য সকল ব্লগার ভাইদেরকে কাহাফ ভাইয়ের আম্মার দ্রুত আরোগ্যের জন্য দোয়ার দরখাস্ত করছি।
জাজাকাল্লাহু খাইরান!
২৩ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৭:৩৭
221220
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনিও কাহাফ ভাইয়ের মায়ের জন্য দোয়া করবেন।
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File